Header Ads

রাজধানীতে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ

নাসিমা বেগম গত ১৪ এপ্রিল জ্বরে আক্রান্ত হন। পাঁচ দিন পর জ্বর চলে যায়। কিন্তু তিনি এখনো পুরো সুস্থ নন। হাতে-পায়ে ব্যথা। নাসিমার স্বামী মো. খলিলুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘ওর চিকুনগুনিয়া জ্বর হইছে। এখন জ্বর নেই। তবে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না, কাজ করতে পারে না।’
নাসিমা-খলিলুর দম্পতি রাজধানীর কাঁঠালবাগান ঢাল এলাকার একটি বাড়ির ভাড়াটে। ওই বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে থাকা তিনটি ভবনে এবং দুটি টিনশেড ঘরে ৩৮টি পরিবার থাকে। গতকাল বাড়ির মালিক ও ভাড়াটেদের সঙ্গে বসে হিসাব করে দেখা গেছে, ১৪ এপ্রিলের পর থেকে সেখানে সব বয়সী ৪০ জন জ্বরে আক্রান্ত হন। গতকাল জ্বর ছিল ১০ জনের।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর যেসব এলাকায় চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বেশি দেখা দিয়েছে, কাঁঠালবাগান তার একটি। পান্থপথ, রাজাবাজার, হাতিরপুলেও আক্রান্তের হার বেশি।
উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, লক্ষ্মীবাজার, নারিন্দাসহ রাজধানীর অনেক এলাকায়ই কম-বেশি চিকুনগুনিয়া হচ্ছে বলে চিকিৎসক ও বিভিন্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে হিসাব না থাকায় এবং হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ায় কোন এলাকায় কত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে এ রোগে মৃত্যু না হওয়ায় আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
চিকুনগুনিয়া রোগ ছড়ায় এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে। কাঁঠালবাগান ঢালসহ কয়েকটি এলাকার লোকজন মশক নিধন কার্যক্রম না থাকার অভিযোগ করলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই বলেছে, চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে মশক নিধন কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে।
গতকাল কাঁঠালবাগান ঢাল এলাকার ওষুধের দোকান এস এস মেডিকেল হলের মালিক মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, তাঁর দোকানে সকাল-সন্ধ্যা মানুষ আসছে জ্বর, বমি আর গায়ে ব্যথা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘মানুষ প্যারাসিটামল আর খাওয়ার স্যালাইন কিনছে। এক দিনে ৬০০ প্যাকেট স্যালাইন বিক্রি করেছি। ভাবতে পারেন?’
ওই এলাকার আরও দু-একটি ওষুধের দোকানে কথা বলে একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, চিকুনগুনিয়ার ওষুধ প্যারাসিটামল।
পান্থপথ ও রাজাবাজারেও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি। গতকাল সকালে ওই এলাকার শমরিতা হাসপাতালে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় এক আয়া বললেন, ‘জ্বর না কেয়ামত বুঝলাম না। শরীলে এমন বিষ।’ শুধু ওই আয়ার নয়, হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক পুলক কুমার দেব বলেন, ‘জ্বর নিয়ে ১৬ জন ভর্তি আছে। এদের একজনের ডেঙ্গু। বাকি সবারই চিকুনগুনিয়া।’ বাকিরা যে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত, তা কীভাবে নিশ্চিত হলেন- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘লক্ষণ দেখে।’
লক্ষণ বর্ণনা করে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি থাকা সেখানকার চিকিৎসক সরোজ কুমার ঘরামী বলেন, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর হয়। জয়েন্টে ব্যথা হয়। রক্তচাপ কমে যায়। পাতলা পায়খানাও হতে পারে। চোখ-মুখ ফুলে যেতে পারে।
এ রকম লক্ষণ দেখেই চিকুনগুনিয়ায় কে আক্রান্ত, তা ঠিক করছেন চিকিৎসকেরা। এই রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরীক্ষা করার সুযোগ আছে শুধু আইইডিসিআরে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদি সেব্রিনা বলেন, পরীক্ষার জন্য যত নমুনা আসে, রোগে আক্রান্তের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি।
আইইডিসিআর সূত্র বলেছে, এপ্রিল-মে মাসে তারা ২৬৪টি নমুনা পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ১৯৬টি নমুনায় চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়।
উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালের অধ্যাপক বলেন, ওই এলাকায়ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ আছে।
আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, চিকুনগুনিয়া ভাইরাসজনিত জ্বর, এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এই জ্বর দেখা দেয়।
অবহেলা নয়
আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা বলেন, চিকুনগুনিয়া আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়। তবে এই জ্বরকে অবহেলা করা ঠিক নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, এডিস মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস ছড়ায়। চিকুনগুনিয়া রোগী এলে তার ডেঙ্গুর পরীক্ষাও করানো ভালো। অন্তত একজন রোগীর একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। ওই রোগী এখন সুস্থ।
আইইডিসিআরের পরিচালক এবং চিকিৎসকেরা বলেছেন, সিটি করপোরেশন মশা না মারলে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ কমবে না। এ ব্যাপারে উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম এম সালেহ্‌ ভুঁইয়া বলেন, চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে সদ্যই মশক নিধনের জন্য সাত দিনের একটি ক্র্যাশ কর্মসূচি শেষ হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন ডিএনসিসির পাঁচটি অঞ্চলে নর্দমা পরিষ্কার করা হচ্ছে, ওষুধ ছিটানো হচ্ছে এবং মানুষকে সচেতন করার জন্য পোস্টার-লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ২১ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস প্রতিরোধে সপ্তাহব্যাপী ক্র্যাশ কর্মসূচি শুরু করেন।

No comments

bd24news®. Powered by Blogger.